
‘আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত; কি অসীম বেদনা। …তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না— আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।’… ১৯৩৭ সালের ১ আগস্ট নজরুল তাঁর প্রথম স্ত্রী নার্গিস আসার খানমকে চিঠিতে লিখেছেন এই কথাগুলো। যদিও কারো কারো মতে নার্গিসের সাথে নজরুলের বিয়েই হয়নি, তাই প্রথম স্ত্রী নার্গিস এই কথার কোন ভিত্তি নেই। নজরুল ও নার্গিসের বিয়ের দিন কাবিন নামায় নার্গিসের মামা আলী আকবর খান একটি শর্ত রাখতে চাইলেন, শর্ত হল- ‘বিয়ের পরে নজরুল নার্গিসকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবেন না, দৌলতপুরেই তার সঙ্গে বাস করবে।’ এ অপমানজনক শর্ত মেনে না নিয়ে নজরুল ইসলাম বিয়ের মজলিশ থেকে উঠে গিয়েছিল। তার মানে, সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস বেগমের সঙ্গে নজরুল ইসলামের ‘আকদ’ বা বিয়ে একেবারেই হয়নি। (কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা— মোজাফফর আহমদ পৃষ্ঠা-৬৭)।
নজরুলের ব্যক্তি জীবনের মতো তাঁর কবি মানসেও কয়েকজন নারী বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তাঁর সাহিত্য প্রতিভা বিকাশে নারীদের অবদান যে বেশ অর্থবহ তা তিনি সরলচিত্তে স্বীকার করেছেন অনেক লেখায়। নারীদের সমানাধিকার, নারীর প্রতি অবিচারের প্রতিবাদ, প্রেয়সীর প্রেমের অনিবার্যতা ও মাতৃভক্তির পদতলে যে পরিপূর্ণতা, শ্রদ্ধা ও সম্মানের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন নজরুল। তার কলমে যেমন নারীর সমানাধিকারের দাবি এসেছে তেমনি সেই একই কলমে তিনি এঁকেছেন মাতৃরূপী নারীর মমতাময়ী স্নেহ, প্রেমময়ী নারীর প্রেমমূর্তি, আর বিরহের রূদ্র প্রতাপের প্রতিচ্ছবি। নারীর বধূরূপ, কন্যারূপ, নারীর অসহায়ত্ব, গ্লানি, বঞ্চনা, নারীর উল্লাস, আনন্দ সবকিছুই তিনি দক্ষ হাতে তুলে ধরেছেন। ছড়িয়ে দিয়েছেন সাহিত্যের পরতে পরতে। কখনো কখনো ইতিহাসের জমিন খুঁড়ে তিনি এনেছেন ঐতিহাসিক তাবৎ নারী চরিত্র। যা আজো আমাদের সাহিত্য বিনোদন ও চলচিত্রে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
তৎকালীন সমাজে নারীদের অবদান স্বীকৃত ছিলো না। পুরুষই ছিলো সব কাজের সব বিষয়ের সর্বেসর্বা। নারীদের দেখা হতো পরনির্ভরশীল দুর্বল হিসেবে। কিন্তু নজরুল নিজে একজন পুরুষ হয়ে পুরুষদের সর্বেসর্বা মনোভাবকে দলিত করে তাঁর কবিতায় তুলে এনেছেন অমোঘ সত্য; দ্বিধাহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন সাম্যের বাণী-
‘সাম্যের গান গাই/ আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।/ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।/ বিশ্বে যা কিছু এলো পাপ-তাপ বেদনা অশ্রæবারি/ অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।’
নারীদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় কবি নজরুল যে কতটা উন্মুখ অধীর ছিলেন তার চিত্র ফুটে উঠেছে ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায়। তিনি দাবি তুলেছেন, অসৎ মাতার সন্তান যদি জারজ হয়, তবে যারা অসৎ পিতা, তাদের সন্তানও জারজ হবে। অনৈতিকতার শাস্তি কেবল নারীরা পাবে, পুরুষরা তার ধারও ধারবে না। নজরুল ছিলেন তার ঘোর বিরোধী। তাই কবির ঘোষণা-
‘শুন ধর্মের চাঁই/ জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোনো প্রবেধ নাই!/ অসত্য মাতার পুত্র যদি জারজ পুত্র হয়,/ অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়।’
বর্তমানে নারীদের সমানাধিকার ও নারী ক্ষমতায়নের জন্য বেশ জোরেশোরেই সভা, সেমিনার হচ্ছে, লেখালেখি চলছে। কিন্তু নজরুল আরো কয়েক দশক আগেই নারীদের সমানাধিকারের কথা বলে গেছেন, এখানেই তাঁর চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির মহত্ব আমরা দেখতে পাই। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘সাম্য’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘মনুষ্যে মনুষ্যে সমানাধিকার বিশিষ্ট, স্ত্রীগণও মনুষ্য জাতি, অতএব স্ত্রীগণও পুরুষের তুল্য অধিকারশালী, যে যে কার্যে পুরুষের অধিকার আছে, স্ত্রীগণেরও সেই সেই কার্যে অধিকার থাকা ন্যায় সঙ্গত।’
‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন’ কিংবা ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, দেব খোঁপায় তারার ফুল’- এ ধরনের গানে তার অপার্থিব প্রেমের উৎসরণ লক্ষ্য করা যায়। এ ক্ষেত্রে তাকে প্রেমিক কবি হিসেবে আখ্যায়িত করলেও অত্যুক্তি করা হবে না। বিদ্রোহী রূপের আড়ালে তার চিরায়ত কামনা-বাসনা-প্রেমকে ঢেকে রাখার সাধ্য আছে কার? কবি বলেছেন-
‘নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি প্রাণ,
যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।’
নারীর উৎসাহ-প্রেরণা ও প্রেমের মহিমা তাকে বিদ্রোহী হতে উৎসাহ জুগিয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়ও তার প্রেম প্রকাশিত হয়েছে। নারী হৃদয়ের ব্যর্থতা, ক্ষোভ ও বাসনাকে কবি নিজের বিদ্রোহের উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছেন। নজরুলের সর্বাপেক্ষা অমূল্য সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা এর উদাহরণ।
‘আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি,/ আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!/ আমি উন্মন মন উদাসীর,/ আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশির।’
নজরুলের জীবনে কয়েকজন নারী বিশেষভাবে প্রভাব ফেলেছিল। তাদের সঙ্গে প্রেম ভালবাসা সম্পর্ক গড়ে উঠলেও সেই সব প্রেম ভালবাসা পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেনি। আর তা থেকেই প্রেম ভালবাসার কবিতা ও গানে আনন্দ, আকাঙ্ক্ষা, বিরহ বেদনার সৃষ্টি ঘটিয়েছেন। অনেকের মতে নজরুলের জীবনে প্রেম মূলত তিনবার এসেছিল। প্রথম প্রেম নার্গিস, দ্বিতীয় স্ত্রী প্রমীলা দেবী এবং তৃতীয় বেগম ফজিলাতুন্নেসা। তবে অনেক ক্ষেত্রে উমা মৈত্র’র নাম ও উঠে এসেছে। উমা মৈত্র’র ডাক নাম ছিল নোটন। সেসময়কার ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের মেয়ে উমা। গান শিখাতে গিয়ে নজরুল নোটনের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন বলে অনেকের ধারণা। কেননা কবির বিরহী প্রেমে নার্গিস-ফজিলতুন্নেসার পাশাপাশি উমা মৈত্রের কথাও বলেছেন অনেকে। বলা হয়ে থাকে উমা মৈত্রের কথা কবি তার ‘শিউলিমালা’ গল্পটিতে বর্ণনা করেছেন শিউলি’ নামে রূপক ভাবে। এর মাঝে ফজিলাতুন্নেসার প্রতি কবির অনুরাগ কিংবদন্তীতুল্য। ভালোবেসে না পেয়ে লিখেছেন-
“বুকে তোমায় নাই বা পেলাম,রইবে আমার চোখের জলে। ওগো বধূ তোমার আসন গভীর ব্যথার হিয়ার তলে।”এভাবে নজরুলের অসংখ্য কবিতা ও গানে প্রেম ও বিরহ প্রকাশ পেয়েছে।
প্রেম, বিরহ ও বিদ্রোহী কবি একই সঙ্গে ছিলেন নজরুল, আর ছিলো তার নারীর অবস্থান। শিল্প-সাহিত্যে যেমন ছিলো তার প্রেম তেমনি রয়েছে বিরহ। কারণ বিরহ ছাড়া প্রেমের আনন্দ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। আর প্রেম মানেই তার নারী চরিত্রগুলো। তার রচিত অসংখ্য গান ও কবিতায় বিরহ, অভিমান ও অতৃপ্তর রূপ পরিলক্ষিত হয়। তবে প্রেমিক নজরুলের আসল পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর রচিত গানগুলিতে।
‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, দেব খোঁপায় তারার ফুল’-
আলগা কর গো খোঁপার বাঁধন-,
প্রিয় যাই যাই বলো না-,
যুগে যুগে নজরুল যেমন আমাদের কাছে নতুন হয়ে উঠবেন, তার সাহিত্যের চরিত্রগুলোতে ফুটে উঠবে সাহিত্যের বিভিন্নদিক। নজরুলই আমাদের শিখিয়েছেন, প্রেম মানেই ক্ষোভ বা প্রতিহিংসা নয়, প্রেম মানে নিজে নিজের অবস্থানে থেকে তা লালন করা।